আমরা লড়ছি যৌতুক ও মাদকের বিরুদ্ধে, আপনাকে সাথে নিয়ে!
আমরা আছি শুধু আপনার সহায়তার অপেক্ষায়। আপনার একটু ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় সমাজে বড় ধরণের পরিবর্তন আনতে পারে।
অতি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হয়, অভিশপ্ত যৌতুকবিরোধী আইন থাকা সত্ত্বেও দেশের শহর, নগর, গ্রাম, গঞ্জসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের এখানে-সেখানে প্রকাশ্যে, চুপিসারে যৌতুকজনিত হত্যাকাণ্ড, অত্যাচার, নির্যাতন, আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। পরিণামে মা-বোন হচ্ছেন লাঞ্ছিত ও নারীকুল হচ্ছে অপমানিত। কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা-মাতার সারাজীবনের অর্জিত সম্পত্তি/অর্থ মুহুর্তেই হারিয়ে দরিদ্র পরিবারে পরিণত হচ্ছেন। হবু জামাইয়ের জন্য যৌতুকের টাকা সংগ্রহের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছেন! আর হবু জামাই বাবাজি বর সেই টাকা ফুর্তি করে খরচ/সম্পত্তি ক্রয়ের জন্য ওৎ পেতে বসে থাকেন।
কেমন জামাই তাঁরা, যাঁরা সামান্য টাকার জন্য হবু শ্বশুর-শ্বাশুরিকে বিয়ের আগেই ভিক্ষা করাতে, ফকির বানাতে বাধ্য করছেন? আত্মীয়-স্বজনের কাছে হাত-পাততে বাধ্য করছেন। যে লোক টা হয় তো সারা জীবকন কারো কাছে আত্ম-সম্মানের জন্য কো নদিন কারো কাছে হাত পাতে নি, সেই ভদ্র লোক হয় তো মেয়ের বিয়ের জন্য পাড়ায় না হলেও আত্মীয়দের কাছে ভিক্ষা করছেন। ধিক সেই অপরের টাকা লোভী যুবকদের! নারীদের অপমান করতেই যৌতুক চাওয়া হয়। সূতরাং, যৌতুক দাবীকারীদের আপনার মা-বোনদের বিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
যারা যৌতুক নিচ্ছেন তারা একবারও কি ভেবে দেখেছেন যে, এই যৌতুক চাওয়াটা একেবারে ভিক্ষার পর্যায়ে পড়ে? একটা পরিবারে একজন মেয়ে তো ঠিক ততটাই আদর যত্নে বড় হয়, যতটা একটা ছেলে৷ সেই যত্নের ধনকে আপনার হাতে যখন তুলে দেয়া হচ্ছে, আপনি তাকে আপনার পরিবারের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করছেন, অর্থাৎ শর্তহীন ভালোবাসায় গ্রহণ করছেন তাকে৷ সেখানে ভিক্ষার দান থাকবে কেন? এ টাকা লজ্জার! এ টাকা তে মানুষের দীর্ঘঃশ্বাস জড়িয়ে থাকে। যতটুকু বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে দেখেছি- যৌতুকের টাকার বরকত/কৃপা থাকে না আর এ টাকা দিয়ে কেউ কিছু করতেও পারে না। অধিকন্তু স্বামী-স্ত্রী পবিত্র ভালবাসার বন্ধনে একটি বিশাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সূতরাং, যৌতুক পরিহার করার শপথ করুন আজই, এখনই। যদি আপনি ইতোপূর্বে নিয়্ওে থাকেন, তবে যথাসম্ভব তা ফেরত দেওয়ার সংকল্প করুন আজই। দেখবেন, আপনার সংসার আবার স্বর্গীয় অমৃতে সুগন্ধে ভরে যাবে।
আমাদেরকে পরের টাকায় অন্ধ মোহে বুঁদ হয়ে থাকা যৌতুক লোভী সেই স্বল্প সংখ্যক নষ্ট যুবকদের বুঝাতে হবে। যাদের কারণেই সমাজে অনেক সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
ধর্মীয় গ্রন্থ সমূহের অনুশাসন অনুযায়ী বিবাহ দু’টি হৃদয়ের, দুটি পরিবারের ভালবাসার পবিত্র বন্ধন। অথচ সেই বন্ধনের শুরুতেই অশুভ, অপবিত্র যৌতুকের ছোবলে ভালবাসা, পবিত্রতা পরিণত হয়ে যাচ্ছে ঘৃণা, হিংসা, অপবিত্রতায়! কেউ সীমিত আকারে জামাই-মেয়েকে খুশি হয়ে গিফট-উপহার দিতেই পারে, এতে কোন সমস্যা দেখছি না। যদিও সেই উপহার মেয়ের প্রাপ্য, ছেলের নয়। কিন্তু গরু-ছাগল-ভেড়া কিংবা সবজি বেচাকেনার মতো দর কষাকষি করে যৌতুক নেওয়া কোন ক্রমেই ভদ্র সমাজ করতেই পারে না। এতে নিশ্চিত আত্ম-সম্মান থাকেই না। তবুও কেন এ যৌতুক চাহিদা?
ইসলামী, বৈদিক/সনাতনী এবং অন্যান্য ধর্মীয় দিকদর্শন ও নীতিমালায় যৌতুক লেনদেন ধর্ম ও নৈতিকতা পরিপন্থী কাজ। সেদিক দিয়ে আলেম, উলামা, ইমাম, কাজি, সাধু-সন্তু, গুরু, বৈষ্ণব, ব্রহ্মচারী, বৌদ্ধভিক্ষু সাহেবদের যৌতুক প্রতিরোধে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। এ অভিশপ্ত প্রথাটির মূলোচ্ছেদ এবং দেশকে যৌতুকবিহীন করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন তাঁরা। দেশে লাখ লাখ মসজিদ-মাদ্রাসা, মন্দির, প্যাগোডা রয়েছে এবং এতে রয়েছেন অসংখ্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। এসব আলেম, উলামা, ইমাম, কাজি, সাধু-সন্তু, গুরু, বৈষ্ণব, ব্রহ্মচারী, বৌদ্ধভিক্ষু সাহেব যদি মসজিদ, মন্দিরে যথাক্রমে নামাজ ও পূজার আগে যৌতুক থেকে বিরত থাকার তাগিদ দিতে থাকেন, তাহলে যৌতুকের অভিশপ্ত প্রথা দেশ থেকে বিলুপ্ত হতে পারে। যৌতুক প্রতিরোধে আলেম, উলামা, ইমাম, কাজি, সাধু-সন্তু, গুরু, বৈষ্ণব, ব্রহ্মচারী, বৌদ্ধভিক্ষু সাহেব ও সরকারের কাছে কয়েকটি সুপারিশমালা পেশ করছি-
১. যৌতুক (বরপক্ষ কর্তৃক অন্যায়ভাবে চাহিদাকৃত উপহার, নগদ অর্থ ইত্যাদি) লেনদেন একটি অভিশপ্ত প্রচলন এবং ঘৃণাজনক প্রথা। এর বিরুদ্ধে গণসচেতনতা বাড়াতে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ, প্রবচন, নসিহত, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা অনুষ্ঠান করে যৌতুক প্রতিরোধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা আবশ্যক। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যৌতুকবিরোধী আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। তাই, দেশের অসহায় নারীদের যৌতুকের নির্যাতন থেকে রক্ষা করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
২. যৌতুক দিয়ে বিয়ে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। চাকরী প্রদানের সময় যৌতুক নেন নি বা নেবেন না মর্মে অঙ্গীকার করাতে হবে। যদি কেউ ইতোপুর্বে নিয়েও থাকেন, তবে তা ফেরতে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।
৩. দেশের সব মসজিদে জুমার খুদবার আগে, মন্দিরে পূজা-অর্চনার আগে যৌতুক সম্পর্কে ধর্মীয় বিধান ও হুকুম/নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।
৪. সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত বয়সের ক্লাসগুলোতে ‘যৌতুক’ যে অত্যন্ত জঘন্য, লজ্জাজনক ও অভিশপ্ত প্রথা সে বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
৫. গ্রাম, গঞ্জ, পাড়া-মহল্লায় সর্বস্তরের সমাজ কর্মীদের নিয়ে ‘যৌতুক প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করতে হবে। শুধু তাই নয়, এর বাস্তবায়নের জন্য মুরবি্বদের সচেতন ও শক্ত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যৌতুক দিয়ে বিয়ে-শাদিতে যারা জড়িত তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।
৬. যৌতুক আদায়ে যেসব পাষণ্ড স্বামী স্ত্রীকে চাপ দেয়, মারধর করে বা বাবার বাড়িতে টাকা বা অর্থ আনতে পাঠিয়ে দেয়, তাদের তাৎক্ষণিকভাবে পাকড়াও করে পুলিশে সোপর্দ করতে হবে।
৭. দেশে অসংখ্য কন্যাদায়গ্রস্ত গরিব-দুঃখী, অসহায় বাবা-মার বিয়েযোগ্য কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবার আছে, যারা অভাবের জন্য বিয়ে সুসম্পন্ন করতে পারছে না। বিয়েযোগ্য এসব মেয়ের বিয়ের বিষয়ে দেশের ধনাঢ্য, বিত্তবান ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
৮. দেশের সব জাতীয় সংবাদপত্র, বেতার, টিভি এবং দেশি চ্যানেল মিডিয়াকে যৌতুক প্রতিরোধে যৌতুক-বিরোধী টক শোর ব্যবস্থা করতে হবে। এসব টক শোতে আলেম, ওলামা, ইমাম, কাজি, সাধু-গুরু-বৈষ্ণবদের দিয়ে যৌতুকের ভয়াবহ কুফল পরিণতির কথা জনসমক্ষে তুলে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. যৌতুকবিহীন বিয়ে সম্পন্ন করতে দেশের সর্বত্র নিজ নিজ এলাকার গণ্যমান্য মুরবি্ব, অভিভাবক মহল, ধনাঢ্য-বিত্তবান, আলেম, ওলামা, ইমাম, কাজি, সাধু-গুরু-বৈষ্ণবদের মাধ্যমে যৌতুক লেনদেন বন্ধ করার মন-মানসিকতা তৈরি করতে হবে। মনে রাখবেন, বিয়ে-শাদি মানবজীবনের একটি পবিত্র কাজ। অতএব আসুন, যৌতুক লেনদেন চিরতরে বিলুপ্ত করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে মানবিক কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হই।
কী আছে যৌতুক বিরোধী আইনে?
যৌতুক বন্ধে ১৯৮০ সালে ন’টি ধারা নিয়ে হয় যৌতুক নিরোধ আইন৷ এটাতে কাজ হলো না৷ এরপর ১৯৯৫ সালে হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান আইন করা হলো৷ এ আইনে কঠিন শাস্তির বিধান রাখা হলো৷ শেষ পর্যন্ত এটাও ব্যর্থ হলো৷ সর্বশেষ ২০০০ সালে হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন৷ এরপর এ বছর ‘যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৭’-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে মন্ত্রিসভায়৷ এর আওতায় কোনো নারীর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষের অন্য যেকোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য কোনো নারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা (প্ররোচিত করে) করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, মারাত্মক জখমের জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড বা ন্যূনতম ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে৷
কী কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন?
যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি শুধু নয়, মারণব্যধির মতো আমাদের সমাজে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে৷ যৌতুক যে দেয় এবং যৌতুক যে নেয় দু’জনেই সমান অপরাধী-এই আইনের মূল মন্ত্র জানলেও ক’জন তা মানে? তাই শুধু আইন করে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়৷ এজন্য প্রয়োজন ঘর থেকে ঘরে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া৷ এ ব্যাপারে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর আরও নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত৷ ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যৌতুক বিরোধী প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে৷ পাঠ্যপুস্তকে যৌতুক বিরোধী বিষয় এবং যৌতুক সংক্রান্ত আইনগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে৷ মানবাধিকার সংগঠন ও এনজিওগুলো যৌতুক বিরোধী প্রচারণা চালাতে পারে৷ গণমাধ্যমে যৌতুক বিরোধী প্রচারাভিযানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷
নারীরা কেন যৌতুকের বলি হবে? কেন তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে? এ সমস্যার সমাধান রয়েছে প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি ব্যক্তির সচেতন হয়ে ওঠার মধ্যেই৷ সবার মধ্যে যদি এই বোধ জন্ম নেয় যে যৌতুক এক ধরনের ভিক্ষাবৃত্তি, এর মাধ্যমে কোন সম্মান প্রাপ্তি হয় না, বরং নিজের সম্মানহানিই ঘটে-তাহলে হয়ত আমাদের সমাজ থেকে একদিন এই ভয়াবহ অভিশাপ দূর হবে৷